দিল্লিতে বেড়াতে গেছেন বিকাশ। স্ত্রী গায়ত্রীর খুশির ঠিকানা নেই। বিয়ের দু’বছরে আগরতলা থেকে বাইরে একসাথে আর বেড়াতে যাওয়া হয়নি। বিকাশের ব্যবসা কাম ঘোরাঘুরির ছক। রথ দেখা কলা বেচার মতো। এবার একটু বেশি সময় নিয়ে গেছে। স্ত্রীকে নিয়ে একটু এদিক-সেদিক ঘুরে আসবে বলে। হোটেলর সামনে পৌঁছা পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। ধাক্কাটা লাগলো রিসিপশন ডেক্সে। হোটেলের ফর্মে সম্পর্কের জায়গাটায় স্বামী-স্ত্রী লিখলেন বিকাশ। কাগজ থেকে মাথা তোলার পর মুহূর্তে যে প্রশ্নটা উড়ে এলো তারজন্য তৈরি ছিলনা দু’জনই।
-‘স্যার ইউর ম্যারেজ প্রুফ প্লিজ’।
-‘নেই, মানে মায়ের সঙ্গে আনিনি’। কোনোও মতে সামলায় বিকাশ।
কিন্তু রিসেপশনিস্টের চোখ তাতে রহস্য খোঁজা থামালো না। যাই হোক পূর্ব পরিচিতি ইত্যাদি দেখিয়ে সে যাত্রায় এড়ানো গেল। কিন্তু গায়ত্রী ! বিয়ের দু’বছর পর ম্যারেজ প্রুফ নিয়ে এভাবে প্রশ্ন আসতে পারে ? অবিশ্বাস্য ঠেকছিল তার কাছে।
গল্প মনে হচ্ছে ? মোটেও না। শুধু নামগুলো পাল্টে দিয়েছি। এমন বহু ঘটনা অহরহ ঘটছে আমাদের চারপাশে। ছোট্ট সমস্যা ভেবে এড়িয়ে যাই অনেকে। কিন্তু আরও বড় সমস্যাও আসতে পারে। যেমন সনাতনবাবুর বেলায় দেখুন কি ঝামেলা হল চেন্নাই থেকে মরদেহ আগরতলায় বাড়িতে আনতে। চিকিৎসা করাতে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়েছিলেন। শেষ রক্ষা হয়নি।একদিকে স্ত্রী শোকে বিহ্বল, অন্যদিকে ম্যারেজ প্রুফ দেখাতে পারছেন না বলে মরদেহ আনতে ঝামেলায় পড়েছেন। বিয়ের দুই দশক পরে কার গরজ থাকে ম্যারেজ সার্টিফিকেট নেয়ার !
কিন্তু লাগে তো। আইন অনুযায়ী যেমন বাধ্যতামূলক, তেমনি নানান দরকারেও কাজের। বিয়ের প্রমাণ মানে আর শুধু বিয়ের কার্ড বা এক ফ্রেমে যৌথ ছবি নয়। বিয়ের প্রমাণ মানে ম্যারিজ সার্টিফিকেট। অনেকে আইনের হ্যাপা ভেবে দূরে থাকেন। কিন্তু খোঁজ নিলে জানবেন, প্রক্রিয়া খুব সহজ। সমাজে এমন একটা ধারণা আছে যে, কোর্ট চত্বরে যেতে হলে নাকি পায়ের চটি ঘষে ফুটো হয়ে যায়। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো ‘কোর্ট ম্যারেজ’র জন্য কোর্টে যাবার প্রয়োজন হয়না। সেটা হয়ে যায় সরকারি অফিসে।
ভারতে ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশনের অভ্যাসটা কম। মানুষ হালকা ভাবে নেন।কিন্তু অনেক সময় প্রয়োজনটা এমন ভাবে অনুভূত হয় যে আপনি তখন বেকায়দায়। বিয়ের অনুষ্ঠানপর্ব এবং ভুরিভোজের চেয়ে ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশনের প্রয়োজনীয়তা কোনো অংশে কম নয়। সুপ্রিম কোর্ট কিন্তু ভারতে ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে। শ্রীমতি সীমা বনাম অশ্বিনী কুমার মামলায় বিবাহ নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করার নির্দেশ দেয় শীর্ষ আদালত। সব রাজ্যকে বাধ্যতামূলক ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন করতে বলা হয়।বিবাহিতদের অবশ্যই রেজিস্ট্রেশন করতে হবে হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্ট কিংবা স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্টে।
ভাবছেন দরকার কি আছে ? বিয়ের প্রতারণা, দুই বিয়ে, শিশু বিবাহ, স্ত্রীকে ফেলে চলে যাওয়া, খরপোষ ইত্যাদি তো আছেই, তার সঙ্গে সম্পত্তির অধিকার প্রতিষ্ঠা, সন্তানের উপর অধিকার, পাসপোর্ট ইত্যাদির জন্যও ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন খুব দরকারি। হোটেলে একসাথে থাকতে গেলেও স্বামী-স্ত্রীকে ম্যারেজ সার্টিফিকেট দেখানোটা বাধ্যবাধকতা।
কিভাবে আবেদন করবেন –
এক) আজকাল অনলাইনেই হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্ট এবং স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্টের আবেদনপত্র পাওয়া যায়। তাছাড়াও পাবেন মহকুমা শাসক অফিসে। স্বামী–স্ত্রী উভয়ে সেই আবেদনপত্র পূরণ করে স্বাক্ষরসহ জমা দেবেন।
দুই) উভয়ের সচিত্র পরিচয়পত্র লাগবে।
তিন) স্বামী–স্ত্রীর ঠিকানার প্রমানপত্র চাই।
চার) দু’জনের বয়সের প্রমাণপত্র দরকার।
পাঁচ) একটা হলফনামা লাগবে, যেটায় কোথায় বিয়ে হয়েছে, কবে হয়েছে, স্বামী–স্ত্রীর বয়স, ঠিকানা, নাগরিকত্ব ইত্যাদির উল্লেখ থাকবে।
ছয়) উভয়ের পাসপোর্ট সাইজ ছবি লাগবে।
সাত) সঙ্গে দিন বিয়ের কার্ড। যেখানে উভয়ের নাম–ঠিকানা, বিয়ের দিনক্ষণ এবং কোথায় বিয়ে হয়েছে তার উল্লেখ থাকবে।
আট) যদি সম্ভব হয় তবে যে পুরোহিত বিয়ে করিয়েছেন তাঁর সার্টিফিকেট নেয়া যেতে পারে।
নয়) যদি স্বামী–স্ত্রীর মধ্যে কেউ ধর্মান্তরিত হন তবে তার সার্টিফিকেট দরকার।
দশ) বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে থাকলে তার সরকারি নির্দেশ নামা।
এগারো) আগের পক্ষের স্বামী বা স্ত্রী মারা গিয়ে থাকলে সেই ডেথ সার্টিফিকেট।
বারো) ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশনের সময় সঙ্গে নিতে হবে দু’জন সাক্ষী।
এর মানে এই নয় যে যারা রেজিস্ট্রেশন করাননি তারা বৈধ দম্পতি নন। ধর্মীয় রীতিতে যারা বিয়ে করেন তাদের বৈধতা এখনও দিয়ে যাচ্ছে দেশের সরকার। তারপরও কার কখন কিভাবে এই সার্টিফিকেটটা প্রয়োজনীয় হয়ে উঠে, বলা যায় কি ?
By-সুমি দত্ত