সৃষ্টি কর
শিল্পীর সৃজনশীল কাজ মানুষকে অন্য ভাবে ভাবতে, হৃদয় পরিবর্তনের শক্তি রাখে। স্বপ্ন দেখাতে পারে এক নব দিগন্তের। সম্প্রতি ত্রিপুরা রবীন্দ্র পরিষদে হয়ে গেলো নিখিল ত্রিপুরা বার্ষিক চিত্র ও ভাস্কর্য প্রদর্শনী। এতে ৬৫ জন শিল্পী তাদের শিল্পকর্ম প্রদর্শন করেন। প্রত্যেক শিল্পীর ব্যতিক্রমী চিন্তার নিদর্শন এই প্রদর্শনী। তাদের শিল্পভাষা ও প্রকাশ ভঙ্গি স্বতন্ত্র, ভিন্ন। ইঙ্গিত পাওয়া যায় শিল্পীদের জীবন দর্শনের। এই কক্ষের নানা আঙ্গিকের প্রতিটি শিল্পই চিজেল,ম্যালটের আঘাতে তুলির টানে এক অন্য মাত্রা পায়। যা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। প্রদর্শনীতে মানুষ,প্রকৃতি,জীব জন্তু বিষয় হিসেবে উঠে আসে। প্রদর্শনীতে বিভিন্ন মাধ্যমে রচিত শিল্পকর্মের মধ্যে কয়েকটি নিয়ে এই পর্যাআলোচনা।
স্বপন নন্দী একজন প্রতিষ্ঠিত শিল্পী। তিনি সকল মাধ্যমেই অবলিলায় কাজ করে যান। তবে প্রদর্শনীতে তার কাজটি জল রঙে করা। রঙের খেলায় মত্ত শিল্পী। মনের মাধূরী মেশানো রঙে তিনি চিত্রপট রাঙিয়ে তোলেন। সাহসী রঙের প্রয়োগ দেখা যায়। ক্রিমসন,কালো, নীল রঙের প্রলেপে প্রকৃতির সৌন্দর্য তোলে ধরেন তিনি। তবে সম্ভবত জল রঙের স্বচ্ছতা তিনি তার কাজে রাখতে চানি। তিনি সেটাকে ভাঙতে চেয়েছেন। ছবিতে গভীরত্ব রয়েছে। প্রদর্শনীতে তার আঁকা প্রকৃতি বিষয়ক ছবিটি দৃষ্টিনন্দন কম্পোজিশন।
অভিজিৎ ভট্টাচার্য একজন স্বনামধন্য শিল্পী। প্রদর্শনীতে তার আঁকা ছবিটির নাম ছন্দ পতন। অ্যক্রেলিকে করা কাজটির বিষয় প্রকৃতি । ছবিতে প্রকৃতি সৃষ্ট ভাসমান ফিগারের উঠা নামা দেখা যায় । তিনি তার মানস চোখে দেখা কল্পনার এক জগৎ রচনা করে যান সাবলীল ভাবে। রঙ ব্যবহারে নাটকীয়তা প্রকাশ পায়। রূপ, রঙের বিন্যাসে এক দারুন ভারসাম্য দেখা যায় ছবিতে। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য রয়েছে। তার স্বতন্ত্রশৈলীতে করা ছবিটি এক কথায় দারুন কম্পোজিশন।
শিল্পী ননীগোপাল রায়ের আঁকা ছবিটি প্রদর্শনীটিকে অন্যমাত্রা এনে দেয়। শিল্পী আত্ম প্রচার বিমুখ ছিলেন। তিনি প্রদর্শনীর সবচেয়ে প্রবীন শিল্পী। তার আঁকা জনক নামক মহাত্মা গান্ধীর পোট্রেটটি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তিনি ফুটিয়ে তোলেন । এখানে মহাত্মা গান্ধীর ধ্যানমগ্ন রূপটি তোলে ধরেন তিনি। পুরানো কাজটি পেন্সিল ড্রইং। ছবিটি শিল্পীর কাজের প্রতি নিষ্ঠার পরিচয় বহন করে।
শিল্পী চিন্ময় রায়ের আকা ছবিটির নাম সংরোচন। মাধ্যম অ্যাক্রেলিক। তার কাজে টেক্সচারকে প্রাধান্য দেওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি এই টেকনিকে অসংখ্য কাজ করেন। প্রদর্শনীতে তার ছবিটি আকারে ছোট হলেও মনোগ্রাহী। বিমূর্ত চিত্রটিতে সাদা ও লাল রঙে নারী মুখের প্রফাইল ভিওর ইঙ্গিত দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তোলেন তিনি । নেগেটিভ স্পেসে কালচে সোনালী রঙের আভা ছবিটিকে অন্যমাত্রা এনে দেয়। ছবিটি চিন্ময় রায়ের পরিচয় বহন করে।
শিল্পী মণীষ ভট্টাচার্যের আকা ছবির নাম বিশ্রাম। অস্থির প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও বিপড়ীতে চলা নৌকাগুলি স্থির। তবে ছবির মূল আকর্ষন ব্রাশিং । শিল্পী তুলি চালোনায় মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন । শিল্পী তাঁর অঙ্কন প্রণালীর মাধ্যম
হিসেবে বেছে নিয়েছেন অ্যাক্রেলিককে।মনোক্রমিক ধাচের কাজ। সাইজে ছোট হলেও শৈল্পিক অভিব্যক্তির প্রকাশ পায়।
দেবাশিস বিশ্বাস রাজ্যর শিল্পাঙ্গনে পরিচিত মুখ। তার আঁকার বিষয়বস্তু সাধারণত প্রকৃতি। তিনি প্রকৃতির সৌন্দর্যের মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিতে চান। কলম, জল রঙে আঁকা তার ছবিটি এরিয়াল ভিওতে দেখা চেনা ত্রিপুরার অচেনা রূপ। ছবিতে তার স্বতন্ত্রশৈলী, আঙ্গিক, ছন্দময় রেখা আর বলিষ্ঠ স্ট্রোকের পাশাপাশি রঙ ব্যবহারে মুন্সিয়ানা দেখা যায় । ছবিতে আল্ট্রামেরিন, কোবাল্ট,ভিরিডিয়ানের প্রাধ্যান্য দেখা যায় । রঙ রেখার বৈচিত্রের মধ্যে হারমনি রয়েছে।
শিল্পী সৌরভ দেব্বর্মা মূলত ছাপাই ছবির কাজ করেন।এই ক্ষেত্রে তিনি বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেন। প্রদর্শনীতে তার কাজটির নাম উড়ন্ত যাত্রা। চিত্রটি কনটেম্পোরারী । এরিয়াল ভিওতে আঁকা চিত্রটিতে সেন্টার অব ইন্টারেস্টে একটা ভাসমান মানুষ দেখা যায়। যার হাতে প্রকান্ড ছাতা। যে মানুষটি মেঘের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলছে। সম্ভবত মানব সমাজের প্রগতির বিষয়টি তিনি চিত্রপটে তুলে ধরতে চেয়েছেন।
দেবব্রত দাস মূলত ভাস্কর্য শিল্পী। ত্রিপুরা সরকারী চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ের এসোসিয়েড প্রফেসর। প্রদর্শনীতে তার করা কাজটি ছাপাই ছবি। টেকনিক ভিত্তিক কাজ। তার ড্রইংএ সমকালীন জীবনযাত্রার ছাপ রয়েছে। তিনি নারী মনের অনুভূতিকে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তোলেন। এ্যচিং পদ্ধতিতে করা ড্রইংয়ে ভাস্কর্যের ছাপ রয়েছে।
শিল্পী মিঠুন করের আঁকা পরশ নামক ছবিটি শিল্প সমালোচকদের প্রশংসা কুড়ায়। পেস্টেলে করা ছবিতে দক্ষতার সঙ্গে মা ও ছেলের পরস্পরের সম্পর্কের বিষয়টি তিনি তুলে ধরেন। যে সম্পর্কটা চাঁদের আলোর মত স্নিগ্ধ। জলের মতো স্বচ্ছ। ছবিতে রঙের ব্যবহারে শিল্পী মুন্সীয়ানা দেখিয়েছেন। সর্বোপরি একটি ভালো কমপোজিশন।
জয়দীপ ভট্টাচার্যের আঁকা ভালবাসার বৃষ্টি ছবিটি কনটেম্পোরারী । শিল্পী সাধারণত ফোক স্টাইলে কাজ করেন। প্রদর্শনীর তার কাজটি ফোক ও আধুনিকতার মিশেলে তৈরী। মর্ডান ইন্ডিয়ান আর্টের নির্শন। মিশ্র মাধ্যমে করা ছবিতে উজ্জ্বল রঙের প্রাধান্য দেখা যায়।এই ধরনের কাজের জন্য শিল্পী প্রশংসার দাবী রাখে ।
শ্যামাপ্রসাদ ভট্টাচার্য একজন প্রখ্যাত ভাস্কর। প্রদর্শনীতে তার শিল্পকর্মটির নাম বুল। মাধ্যম কাঠ,লোহা। বিমূর্ত কাজটি কার্ভিং। দারুন টেক্সচার । এক ঘেয়েমী দূর করার জন্য অথবা বুলের শক্তি বোঝানোর জন্য তিনি হয়তো কাঠ লোহার সমন্বয়ে তার শিল্পকর্মটি রচনা করেন। ভাবের সঙ্গে মাধ্যমের একটা দারুন মেলবন্ধন দেখা যায়। তার কাজে আদর্শ স্কাল্পচারের গুনাগুন পরিলক্ষিত হয়। ভাস্কর্যটি তার অনন্য রূপের মাধ্যমে দর্শকের দৃষ্টি আকৃষ্ট করে।
পার্থপ্রতীম চৌধূরীর কাজটি মূলত ড্রইং ধর্মীর। তিনি বাঁশবনের ছবি আঁকেন। মাধ্যম জল রঙ। বাঁশবনের মধ্যে হাওয়া চলাচলে একটা খটমট শব্দ,পাতার দোলা শিল্পী দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরেন। বাঁশবনের শান্ত, নির্জনতার রূপচিত্র প্রকাশ পেয়েছে তাঁর ছবিতে। তার সৃজনশীল প্রচেষ্টার প্রশংসা করতেই হবে।
বিমেলেন্দু চক্রবতী মূলত একজন শিশু সাহিত্যিক। সুপ্রতিষ্ঠিত কবি। একজন ভালো অলঙ্করন শিল্পী। তবে পেন্টিংয়ের ক্ষেত্রও যে তিনি পটু তার নিদর্শন প্রদর্শনীর ছবিটি। প্রদর্শনীতে তার আঁকা তার মজারু নামক ছবিটি সকলের দৃষ্টি কাড়ে ।
শিল্পী দেবব্রত ভারতীর জল রঙের প্রতি দুর্বলতা রয়েছে। তিনি বরাবরই জলরঙে ছবি আঁকেন। পরিষদে তার আঁকা ছবিটি সুদূর প্রসারী কোয়াশা ছন্ন পাহাড়ের দৃশ্য। টোন প্রধান কাজ, লো- ভ্যালু। জল রঙের যে বৈশিষ্ট তা তিনি ভাঙতে চেয়েছেন। তার নিজস্ব ঘরানাতে আঁকা ছবিতে নীলাভ সবুজের প্রাধান্য দেখা যায়। মনোক্রমিক কোয়ালিটির গুনাগুন রয়েছে। ছবিটি একটা প্রশান্তি ভাব তৈরী করে।
মিতালী গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রদর্শনীতে আঁকা চিত্রটির নাম নৃত্যরতা। অত্যন্ত দক্ষতা নিষ্ঠার সঙ্গে আঁকা ছবিতে গাছের রূপ তুলে ধরেন তিনি । নারীকেন্দ্রিক ভাবনায় আঁকা এই গাছগুলি যেন কোন মানবীর রূপ। যারা মনের আনন্দে রাতের অন্ধকারে নেচে চলছেন। চাদের আলো একটা রোমান্টিক পরিবেশ সৃষ্টি করে। সফল আলোকসম্পাত প্রয়োগে ছবিটি এক মায়াবি রূপ পায়। সর্বোপরি মনোরম একটি ছবি।
জীবন কৃষ্ণ শীল নেপালী কাগজকে দুমরে চিত্রপটে সেটে তার উপর ছবি আঁকেন। ফলে একটা দারুন টেক্সচার তৈরী হয় সারফেসে । যার মধ্যে শিল্পী নিজের ভাবনাকে রঙ, রেখায় দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তোলেন। কাজটি তার পরিচয় বহন করে। পরীক্ষামূলক কাজ।
রম্যেন্দু কুমার দাসের ল্যান্ডস্কেপটি আদর্শ স্কেচ । বিষয়বস্তু পাহাড়ি ত্রিপুরা। তবে বিষয়বস্তু এখানে মুখ্য নয়। মুখ্য কাজের শৈলী। কলমকে মাধ্যম করে শিল্পী কাগজে হ্যাচিংএর মাধ্যমে এক অসাধারণ বুনট তৈরী করেন। ছোট বড় রেখার সমষ্টিতে আলোছায়ার প্রকাশ পায় তার ছবিতে। জটিল রেখাঙ্কনে ফুটে উঠেছে ত্রিপুরার অরণ্য পাহাড়ের নিবিড় সম্পর্ক। রহস্যাবৃত পরিবেশ। ছবিতে লাইনের গুন নন্দলাল বসুর কথা মনে করিয়ে দেয়।