মিঠুন কর
ভালোবাসা মাত্র চারটি অক্ষরের বন্ধনে একটা শব্দ।যদিও তার কোন সীমাবদ্ধতা নেই। তার গভীরতা সমুদ্রের চেয়েও বেশী। উচ্চতা অসীম আকাশ ছাড়িয়ে । ভালোবাসাই জগৎ পরিচলনা করে। এগিয়ে নিয়ে যায় ।
আচ্ছা ভালোবাসার জন্য কোন নির্দিষ্ট দিনক্ষণের প্রয়োজন আছে কি? হৃদয়ের অন্তঃস্থলে যে ভালোবাসা অঙ্কুরিত হয়ে এক পুষ্পবৃক্ষে পরিনত হয় নিজেরই অজান্তে। সে তো সর্বক্ষণ হৃদয়ে বিরাজ করে। দোলা দেয় । বিকশিত হয় । প্রস্ফূটিত হয় । সুবাস ছড়ায় চৌদিকে। আমি দেখেছি ভালোবাসার নানা রূপ। ভালোবাসায় দেখেছি ধরার টানে বারিদ বন্ধন ছিন্ন করে, বৃষ্টি ধরায় মিশে যেতে। ভালোবাসার ডানা মেলে প্রজাপতিকে ফুল ফোটাতে। ভালোবাসায় দেখছি চাঁদের স্নিগ্ধতা । হিমালয়ের কঠোরতা, দৃঢ়তা। ভালোবাসা কাঁচের মত স্বচ্ছ। সহজ, সরল, সুন্দর। ভালোবাসা চিরন্তন সত্য। ভালোবাসা জীবনকে সাবলীল করে। ছন্দময় করে তোলে। কখনও মনে হয়েছে ভালোবাসার রঙ হওয়া উচিত নীল। আবার কখনও মনে হয়েছে এর রঙ হওয়া উচিত সবুজ। আবার মনে হয়েছে ভালেবাসার রঙ হোক রামধনুর মতো। আমি দেখেছি ভালোবাসার অমোঘ টানে সিন্ধুকে সাগরের দিকে এগিয়ে যেতে। সাগরে বিলীন হতে। নিশ্চিহ্ন হতে। আমি দেখেছি আকাশের জ্বলন্ত সূর্যকে ভালোবেশে সমুদ্র জলরাশির আলিঙ্গনের ইচ্ছা প্রকাশ করতে । হয়তো বা ভাটার পর যে জোয়ার আসে সেটাও ভালোবাসার টানেই । দেখেছি ভালোবাসার আলো জ্বালতে গিয়ে কিছু মানুষকে মোমের মতো ক্ষয় হতে। প্রশ্ন হচ্ছে তাদের ক্ষয় কি সম্ভব? তাদের ভালোবাসা কি এতই অগভীর? আমি দেখেছি দুটি ভিন্ন প্রজাতির পশুর মধ্যে ভালোবাসার টান। আবার বিপরীতে শ্রেষ্ঠ প্রাণীরা (সবাই নয়) কখনও কখনও ভেসে বেড়ায় নেতিবাচক মনোভাবে । নানা রূপের মুখোশ পরে সে অন্যের হৃদয়সিংহাসনে বসতে চায় । ভালোবাসে, তবে অংক কষে। ভেবে চিন্তে। লাভ ক্ষতির হিসেব করে। সাদামাটা চোখে এটাও ভালোবাসা। তবে ভাসা ভাসা। আসলে ভালোবাসার অন্তরালে এটা এক ধরনের চুক্তি। যা কখনও অমৃতের সন্ধান দিতে পারে না। যা জীবনকে করে তোলে যান্ত্রিক। এটা কি ভালোবাসার পরাজয়? মনুষ্যত্বের পরাজয় নয়? আসলে দায়িত্ব কর্তব্যের বিষয়টিকে মেনে নিয়েও বলছি, ভালোবাসার চূড়ান্ত লক্ষ্য একে অপরকে বোঝা, নিবিড়ভাবে জানা, শ্রদ্ধা করা। যেখানে এই জানাটা পরিপূর্ণতা পেয়েছে সেখানেই ভালোবাসা সার্থক। আমি দেখেছি মানুষের মুক্তির জন্য সারা বিশ্বজুড়ে এমন কিছু প্রেমিককে যারা নিজের পরিবার পরিজনের কথা না ভেবে হাসতে হাসতে কাঁটা বিছানো পথ বেছে নিয়েছে। নিজের জীবন বিপন্ন করেছে । মৃত্যুকে চুম্বন করেছে। নিজের বুকের তাজা রক্তে চেয়েছে পৃথিবীর রুক্ষ কঠিন মাটি কোমল করতে । সুখের বীজ বপন করতে চেয়েছে। শুধু ঐ নিপীড়িত বঞ্চিত মানুষগুলিকে ভালোবেসে । আবার এই মানুষগুলির দ্বারাই তারা কখনও কখনও আঘাত পেয়েছে। ভালোবাসার পরিবর্তে আঘাত আসা নতুন কোন বিষয় নয় । এটা তারা জানতো না এমন নয়। তারা এটা জেনেও নীরবে নিভৃতে চোখের জল পান করতে চায়। বেদনা মাধুর্যে গড়া তাদের জীবন। তারা চায় ভালোবাসার তৃষ্ণা মেটাতে । ভালোবাসা যে তাদের সহজাত স্বভাব। এটাই তো জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। তাদের এই ভালোবাসাকে আপনি কোন স্তরে রাখবেন । সকলে ভালোবাসতে পারে না। কারণ ভালোবাসা পাওয়া থেকে ভালোবাসা দেওয়া অনেক কঠিন। আপনি ইচ্ছা করলেই কাউকে কাঁদাতে পারবেন। তবে হাসাতে পারবেন না। ভালোবাসার জন্য অনুভূতিপ্রবণ একটা সুন্দর হৃদয় থাকতে হবে। মানবীয় মূল্যবোধ না থাকলে ভালোবাসা যায় না।
আমরা বড়রা আমাদের প্রিয়জনকে ভালোবাসি। আবার একটা শিশুও তার মাকে ভালোবাসে। প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কি শিশুর মতো উজার করে ভালোবাসতে পারি। এই জায়গায় আমরা বড়রা শিশুদের কাছে হেরে গেলাম না তো!
টমাস ফুলার বলেছিলেন, ‘ভালোবাসা পাওয়ার চাইতে ভালোবাসা দেওয়াতেই বেশী আনন্দ।’ সেই সুরে সুর মিলিয়ে বলছি, প্রকৃত অর্থে ভালোবাসা শুধু দিতে জানে, নিতে নয়। ভালোবাসা নিজের সর্বস্ব দিয়ে নিঃস্ব হতে চায়। দেউলিয়া হতে চায়। রিক্ত হতে চায়। চোখের জলে পূর্ণতা পেতে চায়। তারই মধ্যে খুঁজে পায় চরম তৃপ্তি, এক স্বর্গীয় সুখ। এই সুখ যারা পেয়েছে তারাই দেউলিয়া হয়েও সত্যিকারের রাজা। তারাই হয়ে উঠে ভালোবাসার প্রতীক।