সভ্যতার সাক্ষী সেই গাছ আগুন খায়! দাবানলে চলে তার জীবনচক্র!

বিজ্ঞান

ফিনিক্স পাখীর কথা শুনেছেন৷ কিন্তু ফিনিক্স গাছ কী কখনও শুনেছেন বা দেখেছেন? কেন ফিনিক্স? কারণ গাছটা আগুন খায়! হজমও করে ফেলে! আগুনের উপরই নির্ভর করে এই গাছের জীবনচক্র৷
সেকুওইয়া ন্যাশনাল ফরেস্ট৷ আমেরিকার সিয়েরা নেভাডা পর্বতমালার দক্ষিণে অবস্থিত এই জঙ্গলটার নাম সেকুওইয়া নামক এক বিশালাকৃতি গাছের থেকে এসেছে৷ এই অঞ্চলে দাবানল একটা নিয়মিত ঘটনা, অথচ সেকুওইয়া গাছ বেঁচে থাকে যুগ যুগ ধরে৷ টিকে থাকতে পারে দাউ দাউ করে জ্বলন্ত জঙ্গলের মধ্যেও৷ শুধু তাই না, গাছটার জন্ম কিম্বা বেড়ে ওঠা আগুনের উপরই নির্ভর করে৷
পৃথিবীর কিছু জঙ্গল অত্যন্ত দাবানলপ্রবণ৷ দাবানলের রোষ থেকে কিছুই বাঁচে না, পশুপাখি, গাছপালা সব জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যায়৷ মাইলের পর মাইল উজাড় হয়ে যায় সব কিছু৷ লেলিহান আগুনের তাণ্ডবলীলার পর গোটা এলাকা জুড়ে কয়েক মুঠো ছাই ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না৷ সেই প্রচন্ড দাবানলেও বেঁচে বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘজীবী এবং সুউচ্চ সেকুওইয়া গাছ৷ এক একটি সেকুওইয়া গাছ ৩০০০ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে৷ লম্বায় প্রায় ৯০ মিটার পর্যন্ত হতে পারে এই দৈত্যাকার গাছগুলি৷ বর্তমানে সেকুওইয়া ন্যাশনাল ফরেস্টে উত্তর আমেরিকার ক্যালিফর্নিয়া প্রদেশে সিয়েরা নেভাডা পর্বতমালার দক্ষিণে অবস্থিত সর্ববৃহৎ এই গাছটির পোশাকি নাম জেনারেল শেরম্যান৷ এর সর্র্বেচ্চ ব্যাস ১১ মিটার, উচ্চতা ৮৪ মিটার এবং আয়তন ১৪৮৭ কিউবিক মিটার৷ আয়তন বা ওজনের নিরিখে এই গাছটি এই মুহূর্তে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গাছ৷ এই গাছটির বয়স ২ হাজার ২০০ বছর৷ অর্থাৎ এই গাছ সাক্ষী থেকেছে রোমান সাম্রাজ্য থেকে শুরু করে যীশু খ্রিস্টের জন্মের, ভারতবর্ষের স্বর্ণযুগে বিশ্বের প্রথম গবেষণাধর্মী বিশ্ববিদ্যালয় নালন্দার পত্তন, শিল্পবিপ্লব, প্রথম, এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের! অসংখ্য ঝড়-ঝাপ্ঢা, দাবানল পেরিয়ে আসা গভীর ধ্যানমগ্ণ এই কালোত্তীর্ণ মহীরুহের সামনে দাঁড়ালে আপনা থেকেই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে৷
স্বাভাবিক ভাবেই মনে প্রশ্ণ আসতে পারে যে শতাব্দীর পর শতাব্দী বিধবংসী লেলিহান আগুন সহ্য করেও কি করে হাজার হাজার বছর বেঁচে থাকে এই সেকুওইয়া! সেকুওইয়া গাছের ছাল ২ ফুট (০.৬ মিটার) পর্যন্ত মোটা হতে পারে৷ এই তন্তুময় ছাল অগ্ণি এবং তাপ নিরোধক বর্মের কাজ করে যাতে আগুনের প্রবল তাপ গাছের গুঁড়ির তত ক্ষতি করতে না পারে৷ তেমনই সেকুওইয়া গাছের ছাল তন্তুময় ও স্পঞ্জের মত৷ ফলে ছালের মধ্যে প্রচুর বাতাসের পকেট থাকে যা তাপ পরিবহনে বাধা দেয়, ও খুব ভালো তাপের অপরিবাহী insulator) হিসাবে কাজ করে৷ সেকুওইয়া গোত্রের গাছে প্রচুর পরিমান জল ও আর্দতা থাকে৷ এই জল ও আর্দতা দাবানলের সময় গাছের তাপমাত্রা কাঠের প্রজ্জলন তাপমাত্রার উপরে উঠতে দেয় না, কাঠকে আগুন ধরে যাওয়া থেকে রক্ষা করে৷ সবচেয়ে ভেতরের অংশ জমাট এবং শক্ত গুঁড়ি বা হার্টউড heartwood)৷
দৈত্যাকৃতি গাছগুলির শঙ্কু আকৃতির ফলে বীজের সাইজ নগন্য, ৪-৫ মিলিমিটার৷ এই ক্ষুদ্র বীজগুলি শক্ত এক ধরণের আঠার সাহায্যে শঙ্কুর মধ্যে আটকে থাকে৷ সাধারণ আবহাওয়ায় কোনোভাবেই এই বীজ শঙ্কুর ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে মাটিতে পড়তে পারে না, তাই নতুন গাছের অঙ্কুরোদগমও হতে পারে না৷ দাবানলের অত্যন্ত উচ্চ তাপমাত্রা এই আঠা গলিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়৷ শঙ্কুর মুখ খুলে যায়, মাটিতে পড়তে পারে বীজ৷ সেকুওইয়া এতো লম্বা গাছ যে মাটির কাছাকাছি আগুন একদম টঙে থাকা শঙ্কু পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না৷ কিন্তু তাপ যেহেতু উর্ধমুখী, তাই সেকুওইয়ার বীজধারক শঙ্কু গুলোর মুখ তাপে খুলে যায়৷ বীজ পরবর্তী কালে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে৷ উপরন্তু সেকুওইয়ার বীজ এতো ছোট যে এক একটা সেকুওইয়া গাছ অজস্র বীজ তৈরী করে ও ছড়িয়ে দেয়৷ তার মধ্যে কিছু হয়ত পুড়ে যায়, কিন্তু বিবর্তনের নিয়ম অনুযায়ী দু-একটা নতুন গাছ তৈরী হওয়ার মত অনুকূল পরিবেশ পায়৷